কোহিনুর ঘিরে প্রচলিত যত মিথ
১৮৪৯ সালে কোহিনূর যখন তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির হাতে আসে, তখন তিনি সেটি রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি নেন।
হীরাটি যে ঠিক কত মূল্যবান, তাও রানীর সামনে তুলে ধরার কথা ভাবলেন লর্ড ডালহৌসি। তাই তিনি ঠিক করলেন, হীরাটির সাথে এর একটি আনুষ্ঠানিক ইতিহাসও পাঠাবেন তিনি।
সেই অনুযায়ী তিনি নিয়োগ দেন দিল্লির একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, থিও মেটক্যাফকে। মেটক্যাফের কাজ ছিল কোহিনুরের ইতিহাসের উপর গবেষণা করা, এবং সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা।
কিন্তু তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ইতিমধ্যেই কোহিনুর সম্পর্কে যেসব গল্পকথা প্রচলিত ছিল, সেগুলোই তিনি তার প্রতিবেদনে আবার উল্লেখ করেন। অথচ তার সেই প্রতিবেদনটিকেই রেফারেন্স হিসেবে ধরে এরপর থেকে হাজার হাজার নতুন আর্টিকেল ও বই প্রকাশিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বহু তথ্যচিত্রও।
ডালরিম্পল ও আনন্দের লক্ষ্য ছিল, অতিরঞ্জন গল্পগুলো বাদ দিয়ে বাস্তব কিছু বের করে নিয়ে আসা। এবং অনেক সমালোচক বলেন সেই কাজটি তারা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছেন। বর্তমানে কোহিনূরের প্রকৃত ইতিহাস জানতে অনেকেই নির্ভর করছেন এই বইটির উপরই।
এই বইয়ে কোহিনুর নিয়ে প্রচলিত কিছু মিথ সম্পর্কে লেখা হয়েছে, তার কিছু এখানে তুলে ধরা হলো।
মিথ ১- ভারতের শ্রেষ্ঠ হীরা
অনেকে কোহিনুরকে ভারতের অন্যতম মূল্যবান হীরা মনে করলেও ইতিহাস ঘেঁটে গবেষকেরা দেখেছেন ১৯০.৩ ক্যারেটের কোহিনুর যখন ব্রিটেনে আনা হয় তার সাথে সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরো দুটি হীরার খোঁজ পাওয়া যায়।
একটি হলো দরিয়া-ই-নূর যার অর্থ আলোর সাগর(১৭৫-১৯৫ ক্যারেট), এবং অপরটি হলো “গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড” হিসেবে পরিচিত অরলভ হীরা(১৮৯.৯ ক্যারেট)।
১৭৩৯ সালে ইরানী শাসক নাদির শাহ যে ধনসম্পদ লুট করেছিলেন সে সময় এই তিনটি হীরাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল।
কেবল উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কোহিনুর হাতবদল হয়ে আবার পাঞ্জাবে ফিরেছিল, তখন থেকেই এটি সর্বশ্রেষ্ঠ হীরার তকমা পেতে শুরু করে, এবং এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আরও বেশি আগ্রহ তৈরি হয়।
মিথ ২: নিখুঁত হীরা
অনেকেই মনে করেন, প্রকৃত কোহিনুর হয়তো একদম নিখুঁত ছিল। কিন্তু কোহিনুরের ওপর অনেকগুলো হলুদ রঙের দাগ ছিল। কয়েকটি দাগ এত বড় ছিল যে, সেগুলোর কারণে হীরাটি ঠিকভাবে আলো প্রতিফলনের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছিল।
সে কারণেই রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী, প্রিন্স অ্যালবার্ট এত বেশি আগ্রহী ছিলেন হীরাটিকে নতুন করে কাটানোর জন্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোহিনুর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা তো নয়ই, এটার অবস্থান বিশ্বের বৃহত্তম হীরার ধারেকাছেও নেই। এর অবস্থান ৯০তম। ফলে, টাওয়ার অব লন্ডনে ঘুরতে যাওয়া অনেক পর্যটককে এর আকৃতি দেখে অবাক হতে দেখা যায়।
কারণ কোহিনুর হীরার ঠিক পাশেই রাখা দুটি কালিনান হীরার সাথে তুলনা করলে কোহিনুরকে অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির বলেই মনে হয়।
মিথ ৩: ভারতের কোল্লুর খনি থেকে এসেছে
অনেকেই দাবি করে থাকেন, কোহিনুর হীরাটি ত্রয়োদশ শতকে ভারতের কোল্লুর খনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবে, কোথায় এটা উত্তোলন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। এবং এই অনিশ্চয়তাই একে বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।
অনেকেই আবার বিশ্বাস করেন, কোহিনুর কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত ভগবদ পুরাণের সেই সিমন্তক মণি। এবং মজার ব্যাপার হলও থিও মেটক্যাফের প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘কৃষ্ণের জীবদ্দশাতেই উত্তোলিত হয়েছিল কোহিনুর হীরা’।
কিন্তু ডালরিম্পল ও আনন্দের বইটিতে জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, কোহিনুর কোনো খনি থেকে উত্তোলন করা হয়নি, এটা সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের কোনো শুষ্ক নদীপৃষ্ঠ থেকে তোলা হয়েছে।
মিথ ৪: কোহিনুর ছিল মুঘলদের মূল্যবান ধন
হীরা যে এক মহামূল্যবান রত্ন এ কথা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষত হিন্দু ও শিখদের কাছে এটি অমূল্য রত্ন। কিন্তু মুঘল ও ইরানীদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন। তারা হীরার থেকেও বেশি পছন্দ করত বৃহৎ, নিখুঁত, উজ্জ্বল রঙের পাথর। আর সেজন্যই কোহিনুর হীরাকে মুঘলদের সবচেয়ে মূল্যবান ধন বলে যে দাবি করা হয়, তা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন না অনেক গবেষক।
মুঘলদের রাজকোষে ছিল বহু ধরনের মূল্যবান ধন-সম্পদ। কোহিনুর হীরা সেগুলোরই একটি। কিন্তু মুঘলরা সবচেয়ে বেশি অধিগ্রহণ করেছিল যেটি, তা হীরা নয়। বরং তাদের বেশি ঝোঁক ছিল বাদাখশানের লোহিতক ও বার্মার পদ্মরাগমণির ওপর।
কোহিনুর বা হীরার প্রতি মুঘলদের যে উদাসীনতা ছিল তা প্রমাণিত হয় আরেকটি ঘটনা থেকেও। কথিত আছে, নির্বাসিত থাকাকালে মুঘল সম্রাট পারস্যের শাহ তাহমাসপকে উপহারস্বরূপ ‘বাবরের হীরে’ বলে যে হীরাটি দিয়েছিলেন, সেটি নাকি আসলে কোহিনুরই ছিল।
বাবরের হীরা পরে আবার দক্ষিণে ফিরে এসেছিল, কিন্তু ঠিক কবে বা কীভাবে আবার মুঘল রাজদরবারে এর প্রত্যাবর্তন ঘটে, তা আজও স্পষ্ট জানা যায়নি।
মিথ ৫: পাগড়ি বিনিময় ও কোহিনুর দখল
এ গল্পটা বহুল জনপ্রিয় যে , মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা নাকি তার পাগড়ির ভিতর কোহিনুর লুকিয়ে রাখতেন। এ কথা জেনে যান নাদির শাহ এবং তিনি এক কৌশল বের করেন। তিনি মোহাম্মদ শাহকে একটি প্রাচীন রীতির কথা মনে করিয়ে দেন যে দুই বাদশাহ পরস্পর দেখা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাগড়ি বিনিময় করবেন।মোহাম্মদ শাহের বুঝতে বাকি ছিল না, নাদির শাহ আসলে হীরাটি ছিনিয়ে নিতে চাইছেন।
অথচ তৎকালীন পরিস্থিতিতে পাগড়ি বিনিময়ে অস্বীকৃতির মাধ্যমে নাদির শাহের বন্ধুত্বের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি বাধ্য হন পাগড়ি বিনিময় করতে। এভাবে পাগড়ি ও কোহিনুরের মালিক বনে যান নাদির শাহ।
কিন্তু পারস্যের ইতিহাসবিদ মারভি বলছেন, বাস্তবে মোহাম্মদ শাহের পক্ষে হীরাটি তার পাগড়িতে লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে কোহিননুর ছিল সর্বকালের সবচেয়ে সুন্দর ও মূল্যবান হীরা, শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনের মাঝে হীরাটি দ্যুতি ছড়াচ্ছিল।
অনেক গবেষকের মতে, এর দ্যুতি এতটাই মুগ্ধকর ছিল যে এটি মুঘল শাসক শাহজাহানের রুবি, পান্না ও মুক্তাখচিত ময়ূর সিংহাসনেও যুক্ত করা হয়েছিল এবং এই হীরাটি বহু বছর শাহজাহানের সিংহাসনে দীপ্তি ছড়িয়েছে।
সিংহাসন তৈরির পর মুঘলরা এক শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষে ক্ষমতায় ছিল।
কিন্তু দেশটির ব্যাপক সম্পদ বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং পারস্যের শাসক নাদির শাহ ভারতবর্ষে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
১৭৩৯ সালে তিনি দিল্লিতে প্রবেশ করেন এবং লুট করেন দিল্লির ধন-সম্পদ। যেগুলো নিজ দেশে নিয়ে যাবার জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন ৭০০টি হাতি, ৪ হাজার উট এবং ১২ হাজার ঘোড়া।
লুণ্ঠিত সম্পদের মধ্যে ছিল সিংহাসনটি, এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষ ছাড়ে কোহিনুর।
সিংহাসন থেকে কোহিনুর হীরাটি সরিয়ে একটি আর্মব্যান্ডে সেটি স্থাপন করেন শাহ, যা তিনি সবসময় তার হাতে পরতেন।
এরপর হাত বদল হয়ে হীরাটি যায় আফগানিস্তানে, শাসকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পার করে সেখানে ৭০ বছর ছিল হীরাটি।
১৮১৩ সাল নাগাদ, এটি ভারতে ফিরে আসে এবং শিখ শাসক রঞ্জিত সিংয়ের দখলে চলে যায়।
এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোহিনুর হীরা নামে একটি অমূল্য সম্পদের গুজব শুনতে পায় এবং এটি সংগ্রহ করার জন্য তারা চেষ্টা শুরু করে।
ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির কাছে হীরা ছিল ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রতীক। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের রত্নের মালিক হোক ব্রিটেন।
মিথ ৬: কোহিনুর অযত্নে কাটা হয়েছিল
ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ী ও পর্যটক জন-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভারনিয়ার তথ্য অনুযায়ী, তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত রত্নালঙ্কারের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের অনুমতি পেয়েছিলেন। ফরাসি এই রত্ন ব্যবসায়ীর ভাষ্যমতে, সম্রাটের ভাস্কর হোর্তেনসিও বোর্গিও খুব বড় আকারের একটি হীরাকে ভুলবশত কেটে ফেলেছিলেন। এর ফলে হীরাটির আকৃতি নষ্ট হয়ে যায় ও তা ছোট হয়ে যায়।
কিন্তু তিনি ওই হীরাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ হিসেবে, যেটা শাহজাহান হীরা ব্যবসায়ী মীর জুমলার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন ।
একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই বিশ্বাস করত, ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ই হয়তো কোহিনুর। কিন্তু বর্তমান সময়ের অনেক গবেষক একমতে পৌঁছেছেন যে, সেটা ছিল আসলে অরলভ হীরা। যা বর্তমানে মস্কোর ক্রেমলিন জাদুঘরের অংশ হয়ে উঠেছে ও সেখানে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
কোহিনুরের দীর্ঘ ইতিহাসে এটি অসংখ্যবার চুরি হয়েছে এবং স্থানান্তরিত হয়েছে। এর হাতবদলের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র।
তাই এই প্রশ্ন এখনও থেকেই যায় পরবর্তীতে এই হীরাটি কোথায় যেতে পারে?
ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানও এই মূল্যবান হীরার ওপর নিজেদের দাবি জানিয়ে আসছে।
বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন এই হীরাটি হলো ‘বিজয়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যের প্রতীক’।
তবে এই হীরাকে ঘিরে যেই ইতিহাস ও বিতর্ক রয়েছে তা চলতে থাকবে। বিতর্কের কথা ভেবে রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানেও ব্যবহার হচ্ছে না কোহিনুর হীরা।
আর তাই এ কথা বলাই যায় – বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে বিতর্কিত হীরার ইতিহাস লেখা চলতে থাকবে যুগের পর যুগ।